পুষ্পেন্দু মজুমদার: প্রায় বেশ কয়েক বছর ধরেই কিছু একটা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ঠিক! শীতের সার্কাস। আগে শীতকাল মানে নভেম্বরের শেষ থেকে মাইকে প্রচার – বিজ্ঞাপন ময়দানে এবার তাঁবু খাটিয়ে রাস্তার ধারে শোভা পাবে সার্কাসে আঁকা হোডিং। এদিকে অলিম্পিক, রোমান, গ্ৰেট ইন্ডিয়ান তো অন্যদিকে নটরাজ সার্কাস। কোথায় গেল সেই সব দিন! এখনকার যুগে মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্দি। এই সোশ্যাল মিডিয়া মানুষকে আরো যন্ত্র থেকে আরো রোবট করে তুলেছে। বাঘ, সিংহ, হাতি দেখার পাঠ তো বহুদিন আগেই সমাপ্ত হয়েছে। জোকার, জিমন্যাস্টিক, জোকারের খেলায় যে টুকু জৌলুসতা ছিল এই সেশনে তার সব শেষ। অথচ বড়দিন, পয়লা জানুয়ারি সার্কাস দেখার মজাই ছিল অলদা। শুধু তাই নয়, দুঃখের কথা এই যে উল্টে ‘সার্কাস’ কথাটা এখন বাংলা ভাষায় একটা শ্লেষাত্মক ব্যঙ্গের রুপ পেয়েছে।
আগে সার্কাসের প্রধান আকর্ষণ ছিল বাঘ – সিংহের খেলা। জলন্ত আগুনের ভিতর দিয়ে বাঘ লাফিয়ে চলে যাচ্ছে, সিংহ টুলের উপর দাঁড়িয়ে সবাইকে অভিবাদন জানাচ্ছে, হাতি ফুটবলে শট মারছে এবং ভাল্লুক বল নিয়ে কেরামতি দেখাচ্ছে। আর হাততালি ফেটে পরছে গোটা সার্কাসের তাঁবু। সে যুগে দর্শকদের মনোরঞ্জন করার জন্য এই ধরনের খেলার আয়োজন করা হত। কিন্তু এখনকার নিয়মের গেঁরোয় সার্কাসে জন্তুদের খেলা দেখানো নিষিদ্ধ। তাই সার্কাসের চরিত্রের কিছুটা বদল হয়েছে। আর এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সেটা আর নেই বললেই চলে! এখন দর্শকদের মনোরঞ্জন জন্য আরো বেশি করে জোড় দেওয়া হয়েছে ব্যালান্সের খেলা, ট্র্যাপিজের খেলা, বাইকের কসরত খেলা, আক্রোবেটিক প্রদর্শন, এবং হাস্যকৌতুক উপর। ট্রাপিজের খেলা অব্যশই বুকের ধুকপুকানি বাড়িয়ে দিত। ফেমাস সার্কাসের মুল আকর্ষন ছিল উটের খেলা, প্রকান্ড জলহস্তীর খেলা এছাড়া জোকারের ভাঁড়ামি তো রয়েছেই।
হারিয়ে যাচ্ছে শীতের সার্কাস!
বাঙালির সার্কাস
বাঙালির সার্কাসের প্রসঙ্গে একজনের নাম বারবার উঠে এসেছে তিনি হলেন প্রিয়নাথ বোস। প্রিয়নাথ বোস জন্মগ্ৰহন করেন ২৪ পরগনার জেলার ছোটো জাগুলিয়া গ্ৰামে। পরে নিজস্ব স্বতন্ত্র আখড়া স্থাপন করেন যার প্রথমটি ছিল নিজের বাড়ির কাছে, কর্ন ওয়ালিস স্ট্রিটে। সিমলে (বর্তমানে বিবেকানন্দ রোড) থেকে নেবুতলা (সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার) পর্যন্ত গোটা পঞ্চাশের আখড়া করেন – এর প্রত্যেকটিতে ব্যায়াম শেখাতেন আর মনে মনে নিজের সার্কাস দল খোলার স্বপ্ন দেখতেন। এরপর তিনি মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বীরভূম, বাঁকুড়া নানা জেলায় খেলা দেখিয়ে কিছু রোজগার করতেন এবং সেই রোজগারের টাকা দিয়ে সার্কাসের বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনতেন আর দুএকজন খেলোয়াড় জোগাড় করলেন যারা সার্কাস খেলা দেখাবে। এবং দলের নাম দিলেন “Professor Bose’s Great Bangal Circus’। সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৮৭ সালের পাশাপাশি সময়ে। ১৮৯৬ সালে গ্ৰেট বেঙ্গল সার্কাস গোয়ালিয়র মহারাজের জয়বিলাস প্যালেসে খেলা দেখান। একই বছরের নভেম্বর মাসে রেওয়ার মহারাজের কাছে খেলা দেখান।
আরও খবর: নতুন বছরের আগে বেলপাহাড়ীতে পর্যটকদের ভিড়
এখানেই খেলা দেখাতেন একজন মহিলা নাম সুশীলা সুন্দরী। তিনি বাঘের খেলা দেখাতেন খাঁচায় ঢুকে গিয়ে। বাঘের খেলা ছাড়াও জিমন্যাস্টিক এবং ট্র্যাপিজের মতো খেলায় ছিলেন সমান দক্ষ। গ্ৰেট বেঙ্গল সার্কাসের নামকরা জিমন্যাস্ট ছিলেন পান্নালাল বর্ধন। তাঁর স্পেশাল্যিটি হরাইজেন্টাল বারের খেলায়। প্রিয়নাথ বসুর নিজের কথায়, ব্ল্যাক ফাইং, ডবল সমারসেনল্টের মতো দক্ষতা ইংরেজ মধ্যে বিরল ছিল। বিজ্ঞাপনে ছবি আঁকার জন্য ছিলেন গনপতি চক্রবর্তী।
একটা সার্কাস চালানো মানে বিপুল আর্থিক খরচ। বদলেছে মানুষ চাহিদা ও রুচি। যতদিন যাচ্ছে আড়াই ঘণ্টা সার্কাস শোয়ে আকর্ষন আর নেই বললেই চলে! প্রানীদের রক্ষনাবেক্ষণ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় দেখভাল করা তারপর প্রানীদের উপর বিধিনিষেধ করা হয়েছে বলে, তারপর কম টাকা ঝুঁকির পরিমাণ বেশি থাকায় অনেকেই এই পেশায় প্রতি আগ্ৰহ হারিয়েছে। ফলে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে সার্কাস। এবং ক্রমেই তা বিলুপ্তির পথে। পরিশেষে একটাই গানের লাইন মনে পরে “ফিরবে না সেকি ফিরবে না, ফিরবে না আর কোনওদিন!