প্রতিবন্ধকতার কাছে হেরে যাবে রঞ্জিতের মেধা?
নিজস্ব প্রতিবেদন,পুরুলিয়া : পুরুলিয়া জেলার পুঞ্চা থানার পাকবিড়রা গ্রামের রাইডি টোলার অধিবাসী রঞ্জিত কালিন্দীর জন্ম হয় এক হত দরিদ্র পরিবারে। প্রথমে রঞ্জিত চোখে দেখতে পেলেও বর্তমানে তার দৃষ্টি শক্তি সম্পূর্ণ হারিয়েছে সে। দৃষ্টিহীন হওয়া সত্বেও পড়াশোনার প্রতি তার টান যথেষ্ট অনুপ্রেরণাদায়ক। তার এই শিক্ষার প্রতি একাগ্রতা এবং অধ্যাপক হবার স্বপ্নের মাঝে কেবল প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ তাঁদের আর্থিক অনাটন ভরা সংসার। দুঃখের সংসারে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটে না তাঁদের। চোখের জল মুছে রঞ্জিতের মা খুল্লনা কালিন্দী বলেন,”পরের বাড়িতে কাজ করে অনেক কষ্টে ছেলেকে পড়িয়েছি।একদিকে তার পড়াশোনা, অন্যদিকে সংসার চালানো। এখন আর পেরে উঠতে পারছি না। রঞ্জিত আরো পড়াশোনা করতে চায়। প্রতিমাসে যে ১ হাজার টাকার ভাতা রঞ্জিতকে দেওয়া হয়, তাও ওর চিকিৎসার পেছনে চলে যায়।” ২০১০ সালে লাখড়া উপেন্দ্রনাথ হাইস্কুল থেকে ৬৯ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাস করে রঞ্জিত। তারপর নিজের লৌলাড়া রাধাচরন একাডেমী স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি হয় সে। তবে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারী মাস নাগাদ হঠাৎই প্রচণ্ড মাথা ব্যথার যন্ত্রনায় ভুগতে থাকে রঞ্জিত । পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে, সিটিস্কান রিপোর্টে ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে এবং আসতে আসতে দৃষ্টিশক্তি হারায় রঞ্জিত
রঞ্জিত নিজের জীবন সংগ্রামের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে জানায়, “গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় ও সরকারিভাবে সাহায্য পেয়ে কলকাতার একটি হাসপাতালে ব্রেন টিউমারের অপারেশন হয়। পরে সুস্থ হয়ে উঠলে পূর্ব মেদিনীপুরে ‘বিবেকানন্দ মিশন রেসিডেন্সিয়াল স্কুল ফর ব্লাইন্ড’ স্কুলে ব্রেইলের মাধ্যমে একাদশ শ্রেনীতে আবারও নিজের পড়াশোনা শুরু করি। সেখান থেকে ২০১৪ সালে ৭৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর পুরুলিয়া জেকে কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে, পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে ২০২০ সালে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ করি।” তার এই ডিগ্রি অর্জন করার কাহিনী খুব সহজ মনে হতেই পাড়ে। কিন্তু আদতে তা নয়।
এককালীন তার দৃষ্টি শক্তি থাকলেও, হঠাৎই তা হারানো ঘটনা মেনে নেওয়া খুব একটা সহজ ছিল না রঞ্জিতের কাছে । রঞ্জিত দেখতে না পেয়েও ২০১৯ সালে স্রেফ জেদের বশে একপ্রকার লড়াই করেই নেট (NET) পরীক্ষা দেয়। শুধু তাই নয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সে। সরকারি সহায়তায় একটি ঘর পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন রঞ্জিতের বাবা পূর্ণ কালিন্দী। বৃত্তি ছিল ঢাক বাজানো। অনুষ্ঠানে কিংবা পুজোয় ঢাক বাজানোয় যত টাকা পেতেন তা দিয়ে সংসার চালানোর খরচ যোগার করলেও, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এখনও ঢাক বাজানোর ডাক এলেও শরীর আর এখন সায় দেয় না রঞ্জিতের বাবার। জানা যায় করোনা অতিমারিতে লকডাউনের প্রথম পর্ব থেকেই পরিবারের আর্থিক সংকট আরো প্রকট হয়। জয় জহার প্রকল্পে মাসিক ১ হাজার টাকা ভাতা পান পূর্নবাবু তাতে সংসার চলে না তাদের। আর রঞ্জিত প্রতি মাস ১ হাজার টাকা যে দৃষ্টিহীন মানবিক ভাতা পায় তাতে তার ঔষুধ কিনতেই শেষ হয়ে যায়। তার লক্ষ্য অধ্যাপক হওয়া। সে আজ চোখে দেখতে না পেলেও অনুভব তো করতে পারে ! এভাবে নিজের চোখের সামনে তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন ভেঙে যেতে দেখা তার কাছে যথেষ্ট বেদনাদায়ক।সরকারের কাছে কালিন্দী পরিবারের আবেদন তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এমন কিছু ব্যবস্থা করা হয় যাতে অন্তত তাঁদের সংসারটাও বাঁচে আর রঞ্জিত যাতে পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে পারে । এবিষয়ে পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি সুজয় ব্যানার্জী বলেছেন , “রঞ্জিতের যখন শরীর খারাপ হয় তখন কেউ পাশে দাঁড়ায় নি। আমার কাছে যখন এসেছিল তখন কলকাতা চিত্তরঞ্জন ম্যাডিকেল হাসপাতালে তার ব্রেন টিউমারের অপারেশনের ব্যবস্থা করেছি।
এমনকি রঞ্জিতের বাবার মাধ্যমে এখনও কিছু কিছু করে অর্থ দিয়ে সাহায্য করে থাকি।” তবে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা কিন্তু থেকেই গেল তার। সরকার কর্তৃক প্রকৃত সাহায্য করা হবে কিনা কিংবা রঞ্জিতের পড়াশোনার কোন দ্বায়িত্ব তারা নেবেন কিনা সেবিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।